মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৩:৫৫ অপরাহ্ন

৩২ নম্বর বাড়ি গুঁড়িয়ে দিল ছাত্র-জনতা

৩২ নম্বর বাড়ি গুঁড়িয়ে দিল ছাত্র-জনতা

রাজধানীর ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর এক্সকাভেটর-ক্রেন দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। আগুন দেওয়া হয়েছে ধানমণ্ডি ৫/এ সড়কে শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনেও। খুলনায় এক্সকাভেটর-ক্রেন দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাইয়ের বাড়ি, যা ‘শেখবাড়ি’ নামে পরিচিত। বরিশালে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর বাসভবন।

সাদিক আবদুল্লাহ শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে।
একইভাবে এক্সকাভেটর-ক্রেন দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুবউল আলম হানিফের পরিত্যক্ত বাড়ি এবং সিলেটে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল। বরিশাল নগরে বুলডোজার দিয়ে ভাঙচুর করা হয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমুর বাসভবন। ভোলা সদরে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের বাড়িতে আগুন দেয় ক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা।

অন্যদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মীয়মাণ দুটি হলসহ মোট চারটি হলে শেখ মুজিব এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম থাকা ফলকগুলো ভেঙে নতুন নাম দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ এবং নগরের জামাল খান এলাকায় শেখ মুজিবের ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়েছে। রাজধানীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নামফলক থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি তুলে ফেলা হয়েছে। শেখ মুজিবের ম্যুরাল ভাঙচুর করা হয়েছে রংপুরেও।

ভারত থেকে শেখ হাসিনার অনলাইন ভাষণের প্রতিবাদে গতকাল বুধবার রাতে এসব ঘটনা ঘটে। এমন এক দিনে এই ঘটনাপ্রবাহ চলেছে, যেদিন গণ-আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের ছয় মাস পূর্ণ হলো।

গত রাত ৮টার পর থেকেই বিপুলসংখ্যক মানুষ ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে জড়ো হয়। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ও বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে ছাত্র-জনতা।

লাঠিসোঁটা ও শাবল হাতে ভাঙচুরে যোগ দেয় অনেকে। কেউ কেউ বাড়ির দেয়াল ভাঙার চেষ্টা করে। জানালার গ্রিল, কাঠ ও ফটকের অংশ ভেঙে নিয়ে যেতে দেখা যায় কাউকে কাউকে। এ সময় ভেতর থেকে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর’, ‘স্বৈরাচারের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’—এসব স্লোগানের পাশাপাশি ‘দিল্লি না ঢাকা, আবু সাঈদ-মুগ্ধ শেষ হয়নি যুদ্ধ’, ‘জনে জনে খবর দে, মুজিববাদের কবর দে’ ইত্যাদি স্লোগানও শোনা যায়। এই ভিড়ের মধ্যে দর্শকের সংখ্যাও কম নয়। তারা বাড়ির সামনের পরিস্থিতি দেখছে, মোবাইল ফোনে ছবি তুলছে বা ভিডিও করছে, আবার চলেও যাচ্ছে। ভাঙচুরের এক পর্যায়ে রাত ৯টার দিকে শেখ মুজিবের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ির তৃতীয় তলায় প্রথমে আগুন দেওয়া হয়। এর মধ্যে চলে ভাঙচুরও।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের দিন শেখ মুজিবুর রহমানের এই বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছিল। গতকাল ব্যাপক ভাঙচুরের পর ভেতরে পোড়ার মতো যা কিছু আছে, তাতে আবারও আগুন দেওয়া হয়। এ সময় নারকেলগাছের পাতাও জ্বলতে দেখা যায়। আগুন জ্বলতে দেখা যায় ৩২ নম্বরের ওই বাড়ির পাশের একটি ভবনেও।

ঐতিহাসিক এই বাড়ি ঘিরে মানুষের বিক্ষোভের মধ্যে রাত পৌনে ১১টার দিকে সেখানে বুলডোজার-ক্রেন পৌঁছে। মানুষের উল্লাসধ্বনির মধ্যে সেটি মূল সড়ক থেকে ৩২ নম্বরের সড়কে ঢোকে। বুলডোজারের ওপরে উঠে স্লোগান দিতে থাকে অনেকে।

এই পরিস্থিতির মধ্যে ৩২ নম্বর বাড়ির উল্টো পাশে খোলা জায়গায় প্রজেক্টরে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হচ্ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই আয়োজন করে। সেখানে মাইকে ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, ‘আমরা আন্দোলনের প্রামাণ্যচিত্র দেখাচ্ছি। আপনাদের যাঁদের ভাঙার ইচ্ছা আছে, তাঁরা সামনে গিয়ে ভেঙে আসেন। এখানে যাঁরা প্রামাণ্যচিত্র দেখতে চান, তাঁদের সুযোগ দিন।’

এসব কর্মসূচির কারণে ধানমণ্ডি এলাকার নিরাপত্তা বাড়ানোর কথা বলা হলেও রাস্তার ওপর দুটি পুলিশ ভ্যান ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তেমন কোনো অবস্থান ওই এলাকায় দেখা যায়নি। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে এই পরিস্থিতি চলার মধ্যেই আগুন দেওয়া হয় ধানমণ্ডি ৫/এ শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনে।

শেখ হাসিনার সরকার পতনের ছয় মাস পূর্ণ হয় গতকাল। আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে ঘোষণা দেওয়া হয়, রাতে ভার্চুয়াল এক অনুষ্ঠানে ভাষণ দেবেন তাদের নেত্রী শেখ হাসিনা। বিষয়টি নিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া আসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে, যারা গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়।

সংগঠনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘হাসিনাকে বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ দেওয়াকে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদবিরোধী জনগণের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ হিসেবে দেখি।’ পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ফেসবুকে আরেক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘আজ রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমিমুক্ত হবে।’

এর আগেই গতকাল বিকেলে আলোচিত অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ইলিয়াস হোসাইন ও পিনাকী ভট্টাচার্য ফেসবুকে ‘ধানমণ্ডি ৩২ অভিমুখে বুলডোজার মিছিল’ ঘোষণা করেন। একটি ফটোকার্ডও শেয়ার করেন তাঁরা। তাতে বলা হয়, ‘হাজারো ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালিয়ে দিল্লি পালিয়ে গিয়ে সেখান থেকেই খুনি হাসিনার বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার প্রতিবাদে ২৪-এর বিপ্লবী ছাত্র-জনতার উদ্যোগে আজ (বুধবার) রাত ৯টায় এই কর্মসূচি পালিত হবে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর থেকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের এই তিনতলা বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। এই বাড়িতে থেকেই তিনি পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬২ সালের আইয়ুববিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৭০ সালের নির্বাচন, একাত্তরের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনসহ বাংলাদেশের ইতিহাসের নানা চড়াই-উতরাইয়ের সাক্ষী এই বাড়ি। এই বাড়ি থেকেই একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে এই বাড়িতেই সপরিবারে তাঁকে হত্যা করা হয়।

১৯৮১ সালে তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা দেশে ফিরলে শুরুতে তাঁকে ওই বাড়িতে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। পরে ওই বছরের ১০ জুন ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার পর শেখ হাসিনা বাড়ির মালিকানা পান। তবে তিনি সেখানে থাকেননি। শেখ হাসিনা বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের জন্য বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের কাছে হস্তান্তর করেন। বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করে এবং নাম দেয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর’।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। কয়েক ঘণ্টা পর গণভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে হাজারো মানুষ। ঢাকায় শেখ মুজিবের বেশ কিছু ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর সেদিন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে হামলা চালিয়ে লুটপাট ও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুড়ে যায় তিনতলা বাড়ির প্রতিটি কক্ষ। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ভবনের সামনের দিকে শ্রদ্ধা নিবেদনের অংশে রাখা শেখ মুজিবের প্রতিকৃতিও।

শেয়ার করুন .....




© 2018 allnewsagency.com      তত্ত্বাবধানে - মোহা: মনিকুল মশিহুর সজীব
Design & Developed BY ThemesBazar.Com