মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ০১:১৩ অপরাহ্ন
বিনোদন ডেস্ক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের ক্লাস চলছে। ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষার্থীদের প্রিয়, বন্ধুসুলভ ও রসবোধসম্পন্ন শ্রদ্ধাভাজন একজন শিক্ষক। শিক্ষকের কোনো একটা কথায় শিক্ষার্থীরা হো হো করে হেসে উঠল। সে হাসি ছড়িয়ে গেল ক্লাসরুমের বাইরে। ঠিক সে সময় ওই বিভাগের প্রধান ক্লাসরুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন সেই শিক্ষক।
শিক্ষার্থীদের হাসিতে তিনি প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন। সোজা ঢুকে গেলেন ক্লাসরুমে। শিক্ষার্থীদের সামনে কলার চেপে ধরলেন ক্লাস শিক্ষকের। বাজখাই গলায় বললেন, ‘এটা কি নাট্যশালা? এত হাসাহাসি হচ্ছে, এটা ক্লাসরুম, নাকি নাট্যশালা?’ আরও শাসিয়ে চলে গেলেন বিভাগীয় প্রধান। ক্লাসের বাকি সময়টা ক্লাসরুমে বসে সেই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সামনেই হুহু করে কান্না করলেন।
ছাত্রদের সামনে শিক্ষকের কলার ধরা সেই বিভাগীয় প্রধানের নাম সৈয়দ জামিল আহমেদ। যিনি শিল্পকলার ডিজি থেকে পদত্যাগ করে আলোচনায় এসেছেন। ডিজি হিসেবে তার নিয়োগ নিয়েও প্রচুর আলোচনা হয়। বিপ্লবের পক্ষের ছাত্র-জনতা তার নিয়োগ মেনে নিতে পারেনি। নাট্যাঙ্গনেও তুমুল সমালোচনা হয় তার নিয়োগ নিয়ে।
উল্লিখিত ঘটনা থিয়েটার অ্যান্ড পারফম্যান্স স্টাডিজ বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে বহুল চর্চিত বিষয় ছিল। যদিও বিভাগীয় প্রধানের ভয়ে কেউ বাইরে এ নিয়ে টু-শব্দটি করেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বিভাগের এক সাবেক শিক্ষর্থী এ ঘটনার হুবহু বর্ণনা দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী আমার দেশকে জানান, সৈয়দ জামিল আহমেদ বিভাগীয় প্রধান থাকাকালে বিভাগে মসজিদ নির্মাণের জন্য কুয়েত সরকারের পক্ষ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা অনুদান আসে। সেই টাকা দিয়ে মসজিদ নির্মাণ না করে তিনি রিহার্সেল কক্ষ বানান। এ ঘটনা নিয়েও সে সময় বেশ আলোচনা হয়। কিন্তু জামিল আহমেদ আওয়ামী সরকারের উচ্চপদস্থদের দিয়ে সব ম্যানেজ করে ফেলেন। প্রভাব খাটিয়ে ধামাচাপা দেন পুরো বিষয়টি।
আরো অভিযোগ, বিভাগে তার অপছন্দের শিক্ষার্থী প্রথম স্থান অর্জন করে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এগিয়ে গেলে সেই শিক্ষার্থীর টিভি নাটকে অভিনয় করার ‘অপরাধে’ সেমিস্টারের রেজাল্ট বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা দিতে বলেন। জামিল আহমেদ ওই শিক্ষার্থীকে বলেন, ‘তুমি থিয়েটার পড়তে এসে নাটক করো?’ ওই শিক্ষার্থী রাগে-দুঃখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বাদ দিয়ে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতক সম্পন্ন করেন।
ভীষণ বদরাগী হিসেবে পরিচিত সৈয়দ জামিল আহমেদ তার স্বভাব ধরে রাখেন শিল্পকলার ডিজির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসার পরও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্যকালে শিল্পকলা একাডেমির সচিবের কাছে লিখিত পদত্যাগপত্র দাখিল করেন।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর দাখিল করা পদত্যাগপত্রে তিনি কোনো কারণ উল্লেখ না করলেও পরবর্তীতে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কিছু কারণ উল্লেখ করেন, যাতে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগের প্রতি কিছু অসত্য, বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার বিষয়ে অসত্য, মনগড়া ও ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক বক্তব্য রয়েছে।
জামিল আহমেদের পক্ষ থেকে তোলা ‘একটি ভিডিও নির্মাণের বিষয়ে চিঠিপত্র ছাড়া টাকার জন্য চাপ’ দেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ অসত্য ও বানানো বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত ২০-২১ ফেব্রুয়ারি প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে অন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ২৫ বছরপূর্তির অনুষ্ঠান হয়। ওই অনুষ্ঠানে বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয়ে বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করে। অনুষ্ঠানে মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস সংরক্ষণে বাংলাদেশের অবদান তুলে ধরে বিশেষভাবে নির্মিত একটি ১৫ মিনিটের ভিডিও এবং একটি লাইভ প্রোগ্রাম উপস্থাপন করা হয়।
ভিডিওটি নির্মাণের জন্য গত ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠির ২নং অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছেÑ আধুনিক ও যুগোপযোগী ভিডিও বানানোর স্বার্থে নিয়ম অনুযায়ী অগ্রিম কিছু অর্থ নির্মাতাকে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক সম্পূর্ণ অসৌজন্যমূলক আচরণ করে বাজেট বরাদ্দ না দিলে অর্থ দেওয়া হবে না মর্মে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার অনুরোধকে নাকচ করেন। অথচ মহাপরিচালক এর আগে ‘সাধু মেলা’ অয়োজনের জন্য শুধুমাত্র উপদেষ্টার মৌখিক কথায় প্রায় ৩৩ লাখ টাকার প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়। সাধারণত জরুরি বিবেচনায় মন্ত্রণালয় তার দপ্তর-সংস্থাগুলো কাজ এভাবেই এগিয়ে নেয়।
কিন্তু এবার আগেই চিঠি দেওয়া হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন ও সমন্বয়ের জন্য উপদেষ্টা, ইউনেস্কো সদর দপ্তর, বাংলাদেশ দূতাবাস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ভিডিও নির্মাতা ও শিল্পকলা একাডেমিকে সংযুক্ত করে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হয়। কিন্তু শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক অসৌজন্যমূলকভাবে ওই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যান। বাংলাদেশের সম্মান বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের কথা, শত শত শহীদের কথা ইউনেস্কো সদর দপ্তরে উপস্থাপন করার জন্য যেখানে শিল্পকলা একাডেমির আরো ঘনিষ্ঠভাবে সাহায্য করার কথা, সেখানে শিল্পকলার মহাপরিচালকের এমন অসৌজন্যমূলক আচরণ ও মিথ্যাচার জুলাই গণঅভ্যুত্থান, ২০২৪-এর শহীদদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের শামিল।
মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে আরো জানা যায়, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি একুশে পদক বিতরণের রিহার্সেল অনুষ্ঠানে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় সংগীত ও আবহ সংগীত পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে রিহার্সেলে আসতে না দিয়ে মিটিংয়ের নামে আটকে রাখেন সৈয়দ জামিল আহমেদ ।
একই অনুষ্ঠানের পদক বিতরণে জাতীয় সংগীতে অংশগ্রহণকারী একজন সংগীতশিল্পীকে শুনানির নামে অংশ নিতে দেননি । সংশ্লিষ্ট শিল্পী একুশে পদকের অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন বলে শুনানি পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করলে তিনি কোনোভাবেই তাতে রাজি হননি।
বরং তিনি তাকে বিষোদ্গার করেন। উল্লেখিত অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে সৈয়দ জামিল আহমেদের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
ডেস্ক/এমএস