মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৫:২০ অপরাহ্ন

ফেসবুকে মেয়েদের ছবি আপলোড, ইসলামের বিধান এবং কিছু কথা

ফেসবুকে মেয়েদের ছবি আপলোড, ইসলামের বিধান এবং কিছু কথা

আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটা সহজ মনে হলেও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব অত্যান্ত ভয়ংকর। কিছুদিন আগে একটা নিউজ পড়েছিলাম ভারতীয় এক মেয়ের ঘটনা নিয়ে। ইন্টারনেটে আপলোড করা তার ছবি নিয়ে কে বা কারা সেগুলো একটা পর্ণ সাইটে কল গার্লদের লিস্টে দিয়ে দেয়। সেটা যখন এলাকায় জানাজানি হয়ে যায় আত্মসম্মানের চরম অপমান সইতে না পেরে মেয়েটিসহ তার পুরো পরিবার আত্মহত্যা করে।যাদের নিয়মিত পত্রিকা পড়ার অভ্যাস আছে তারা হয়ত দেখে থাকবেন, ছবি বিকৃত করে ফেসবুকে ছেড়ে দিয়ে ব্ল্যাকমেইল, নোংরা ছবি ছড়িয়ে পড়ায় অমুকের আত্মহত্যা এই ঘটনাগুলো অহরহ ঘটছে। ফটোশপের এই স্বর্ণযুগে একটি সাদাসিধে ছবিকে নোংরা ছবি বানিয়ে বিশ্রী ক্যান্ড ঘটানো আজ কোন ব্যাপারই না, এমনকি বোঝার উপায়ই থাকেনা যে ছবিটা আসল না নকল!

ইন্টারনেটে বিশেষ করে ফেসবুকে আমাদের বোনেদের নিজের ছবি আপলোডের হিড়িক দেখলে তাই মাঝে মাঝে আঁতকে উঠি। কি ভয়ংকর ফিতনার দরজাই না আমার বোনেরা খুলে দিচ্ছে অনায়াসেই। জাহেল মেয়েরা এসব করে বেড়াবে সেটা স্বাভাবিক কিন্তু তাদের দেখাদেখি আমাদের হিজাবি বোনেরা নিজের ছবি মানুষজনের সামনে উন্মুক্ত করবে এর চেয়ে হতাশার মনে হয় আর কিছু হয়না। আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি অতি উৎসাহী ছেলেদের আমি চোখের সামনে দেখেছি ফেসবুক থেকে হিজাবিদের ছবি মোবাইলে ডাউনলোড করে রাখতে এবং তা বন্ধু বান্ধবদের দেখিয়ে বেড়াতে।

আরেকটা trend দেখা যায় হিজাবি বোনেরা ফেসবুকে জাহেল কায়দার ছবি না দিলেও বেশ ফিতনাময় কায়দায় নিজেদের চোখের ছবি সাথে “চোখে রাখ চোখ” টাইপ ক্যাপশন দিয়ে অনায়াসেই ফেসবুকে আপলোড করে যাচ্ছে। এটা আরও ভয়ংকর। এটা ফিতনার দিকে নোংরা এক ধরনের আহবানের মত। আমরা যদি কুরআনে নারী পুরুষের জন্য পর্দার আয়াতগুলো খেয়াল করি তাহলে দেখব আল্লাহ মুমিন মুমিনাদের প্রথমেই বলেছেন দৃষ্টি অবনত করতে।কেননা সমস্ত জিনার শুরু হয় দৃষ্টি থেকে। যে নিজের চোখের হেফাজত করতে পারে তার জন্য অশ্লীলতা, জিনার মত ব্যাপারগুলো থেকে হেফাজতে থাকার কাজটা সহজ হয়ে যায়। আর সেখানে আমাদের বোনেরা যদি সেই চোখকেই পুরুষের লুলুপ দৃষ্টির জন্য উন্মুক্ত করে দেয় তাহলে ফিতনার চূড়ান্ত ভয়াবহতার দিকেই তা রুপ নিবে।

“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে……” [সূরা নুরঃ ৩০]
“ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে…..” [সূরা নুরঃ ৩১]

আবার কিছু বোন আরও এক ধাপ এগিয়ে নিজেদের ঠোঁটের ছবি আপলোড করে চূড়ান্ত রকম জাহিলিপনার পরিচয় বহন করে। হয়ত ব্যাপারগুলো অজ্ঞতার কারণে কিংবা ফিতনার স্বরূপ বুঝতে না পারার কারনেই হয়ে থাকে। কিন্তু এই বিষয়গুলোতে আমাদের অভিভাবকদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত। ইসলামি ফ্যামিলি হলেও মেয়ে ফেসবুকে কি করছে, যা করছে তা ইসলাম সমর্থন করে কিনা তার খবরাখবর রাখা, ভুল কিছু করলে তা শুধরে দেওয়া, ইসলামের রুলিং জানানো অভিভাবকদের দায়িত্ব। আশা করি এই দায়িত্বে অবহেলার পরিচয় দিয়ে কেউ দাইয়ুস হয়ে জাহান্নামের বাসিন্দা হতে চাইবেন না আর আমাদের হিজাবি বোনেরাও ফিতনার দরোজা উন্মুক্ত করে শয়তানকে সুযোগ দিতে চাইবেন না ইনশাআল্লাহ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ফেসবুকে মেয়েদের ছবি আপলোডের বিষয়ে ইসলামের বিধান কি? বিশেষ করে যখন আমাদের কিছু হিজাবি বোন মনে করেন যে ফেসবুকে নিজেদের হিজাব পরিহিত ছবি আপলোড ইসলামি শরিয়ায় অনুমোদিত?

এর উত্তর হচ্ছে, বেশ কিছু কারণে মেয়েদের ফেসবুকে, চ্যাট রুমে কিংবা অন্য কোন ওয়েবসাইটে নিজেদের ছবি দেওয়া হারামঃ
প্রথমত ইন্টারনেটে ছবি আপলোডের ব্যাপারটা কুরআন এবং সুন্নাহর আলোকে আল্লাহ আয ওয়া যাল মহিলাদের পর্দার মাধ্যমে শরীর ঢেকে রাখার এবং গোপন করার যে বিধান দিয়েছেন তার বিরুদ্ধে যায়। কেননা আল্লাহ সুবাহানু ওয়া তায়ালা নবী পত্নীদের সাথে পর্দার বিষয় আলোকপাত করতে গিয়ে সূরা আহযাবে বলেন,

“তোমরা তাঁর পত্নীগণের কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটা তোমাদের অন্তরের জন্যে এবং তাঁদের অন্তরের জন্যে অধিকতর পবিত্রতার কারণ”। [সূরা আহযাবঃ ৫৩]

“ হে নবী! আপনি আপনার পত্নীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু”। [সূরা আহযাবঃ ৫৯]

এছাড়া আল্লাহ আয ওয়া যাল নারীদেরকে পুরুষের সামনে কোমল স্বরে কথা বলতেও নিষেধ করেছেন,

“হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষনীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, ফলে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে”। [সূরা আহযাবঃ ৩২]

নিউজ বিজয়ের সর্বশেষ খবর পেতে Google News অনুসরণ করুন।

তাই আল্লাহ সুবাহানু ওয়া তায়ালা নবী পত্নীদের এবং সাথে সকল বিশ্বাসী মুসলিমাদের জন্য পর্দার যে বিধান নির্ধারণ করেছেন সেটা মেনে চলা উচিত যাতে তারা ফিতনা থেকে নিরাপদে থাকতে পারেন, নিজেদের সতীত্ব রক্ষা করে চলতে পারেন এবং মানুষের মনে যেন বক্রতার দরুন অহেতুক সন্দেহের সৃষ্টি না হয়।একবার যদি আমরা এটা বুঝতে সক্ষম হই তাহলে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা যে, একজন মহিলা যদি তার ছবি আপলোড করে যা একইসাথে সৎকর্মশীল এবং বক্রহৃদয়ের নীতিহীন মানুষগুলোর কাছে উন্মুক্ত তাহলে এধরনের ওয়েবসাইটে নিজেদের শো করাটা আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ!

দ্বিতীয়ত এটা ছবির মহিলা এবং ছবির দর্শক উভয়ের জন্য ফিতনাস্বরূপ। এই ফিতনার ফলশ্রুতিস্বরূপ অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনা আমরা শুনেছি এবং পড়েছি। অনেক নিষ্পাপ এবং সচ্চরিত্রের মেয়েই এভাবে আল্লাহকে ভয় না করা শয়তানদের মিষ্টি কথা এবং প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পড়ে নিজেদের দ্বীন, আত্মসম্মান সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন। নিজেদের ফায়দা হাসিল করে তারা এসব মেয়েদের জন্য দুনিয়া আর আখিরাতে লজ্জা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট রাখেনি।

অনেক নীতিহীন আলাহর দুশমন মেয়েদের এসব ছবিকে আধুনিক উপায়ে বিকৃত করেছে, কোন মেয়ের মাথা ব্যভিচারি মহিলার শরীরের সাথে লাগিয়ে কুৎসা রটিয়েছে যা মেয়েটির জীবন এবং পরিবারের জন্য মারাত্মক অনুতাপের কারণ হয়েছে আর এই অসম্মান আর অনুতাপ মেয়েটি নিজেই ডেকে এনেছি নিজের ছবি মানুষের কাছে সহজলভ্য করে।

তৃতীয়ত, কিছু কিছু ক্ষেত্রে যদি প্রপার হিজাব মেনে চলা হয় এবং চেহারা ঢেকে রাখা হয় তখন বিশেষ করে প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তা বৈধতা পায়। তবে একজন সচেতন মুসলিমাহ মানেই এটা বুঝতে পারার কথা এই ইন্টারনেটে বিশেষ করে ফেসবুকে নিজেদের ছবি আপলোড করার মাঝে কোন জরুরাত কিংবা বেনেফিশিয়াল কিছু নেই। যা আছে তা হল ফিতনা এবং নিজেদের নিরাপত্তাহীনতা। এমনকি আমরা যদি বলিও যে মহিলাদের মুখ ঢেকে রাখাটা বাধ্যতামূলক নয় তারপরও কোন মুসলিমাহ তার ছবি নেটে ছেড়ে শয়তানের রাস্তায় যে ফিতনার অবতারণা হয় সেটাই যথেষ্ট এটাকে অবৈধ করতে। এক্ষেত্রে পাপের মাত্রাটা মাল্টিপ্লাই হতে থাকে এবং বিপদের আশংকাও বাড়তে থাকে।আর এর মাধ্যমে মুসলিমদের ইতিহাসে বিশ্বাসী মহিলারা আল্লাহর বিধান পালনের যে ধারা অনুসরণ করে এসেছে তার সীমালংঘন করা হয়।

তাছাড়া কারো যদি নুন্যতম কমনসেন্স থেকে থাকে তাহলে তার বোঝার কথা যে, একজন মেয়ের জন্য তার সৌন্দর্য এবং একইসাথে ফিতনা সৃষ্টির মূল কেন্দ্র হচ্ছে তার চেহারা যা পুরুষমাত্রই আকর্ষিত হয়। সেই ফিতনার উৎসকে যদি আমরা পুরুষের জন্য উন্মুক্ত করে দিই, বারবার সেই ছবির দিকে তাকানোর (যেহেতু ছবি স্থির থাকবে এবং কেউ চাইলে সারাদিন ধরেই ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবে) সুযোগ করে দিই, সেই ছবিকে বিকৃত করে অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপনের সুযোগ করে দিই তাহলে তা আমাদের জন্য দুনিয়া এবং আখিরাতে চরম আক্ষেপের কারণ হবে।

তাই আমরা আমাদের সকল মুসলিম বোনদের কাছে অনুরোধ করব তারা যেন ফেসবুকে কিংবা অন্য কোন মাধ্যমে নিজেদের ছবি আপলোড না করেন। যারা ইতোমধ্যে ছবি দিয়েছেন তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে তারা যেন তা সরিয়ে ফেলেন। আমরা আশা করব আপনারা নেজেদের সম্মান এবং ইজ্জতের হেফাজত করবেন ইসলামের মাধ্যমে। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণের আগে আল্লাহকে ভয় করবেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ইসলামের সঠিক বুঝ দান করুন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফজত করুন। আল্লাহ আমাদের বোনেদের পরপুরুষের লুলুপ দৃষ্টি কিংবা ফেসবুকের লাইক কমেন্টের মাধ্যমে নয় ইসলামের মাধ্যমেই সম্মানিত হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন।
===========================
নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত ইসলামে যেমন ফরজ, পর্দা পালন করাও অনুরুপ একটি ফরজ বিধান। সুতরাং বিনা ওজরে পর্দা লঙ্গন হয় এ ধরণের সকল প্রকার কাজই হারাম। বেগানা মহিলাদেরকে দেখা যেমন নাজায়িজ তেমনি তাদের ছবি দেখাও নাজায়িজ, ফেসবুকের ছবি হোক অথবা অন্যকোন ছবি হোক সর্বাবস্থায় তাদের ছবি দেখা নাজায়েজ। ফটো বা ছবি দেখার দ্বারা পাপের পাশাপাশী তা রিদয় যন্ত্রনার কারণ হয়ে দাড়ায়। উপরন্তুু দেখা ও কল্পনার দ্বারা চোখের যিনার গুনাহ হতে থাকে। তাই মেয়েদের ছবি ফেসবুকে আপলোড করা, দেখা কোন মতেই জায়িজ নয়।

ফেসবুকে মেয়েদের ছবি আপলোড করলে যত বেগানা পুরুষ আপলোডকৃত ছবি দেখবে তাদের সকলের সমপরিমাণ গোনাহ আপলোডকারীর আমল নামায় যোগ হবে।
===========================
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুজ দান করুন কুরআন ও সহীহ হাদীসের উপর আমল করা তৌফিক দান করুন আমীন।।

শেয়ার করুন .....




© 2018 allnewsagency.com      তত্ত্বাবধানে - মোহা: মনিকুল মশিহুর সজীব
Design & Developed BY ThemesBazar.Com